জাতির
জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্বাস করতেন কোন বাঙ্গালী তাকে মারতে
পারেনা। বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দা সংস্থা বার বার সতর্ক করার পর ও তার একই
বিশ্বাস, যে পাকিস্তানী আমাকে মারতে পারেনি আর আমার কোন বাঙ্গালী আমাকে
মারতে আসতে পারে না।
নিজের
দেশের মানুষের প্রতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিশ্বাস এতই
দৃঢ় ছিল যে তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র হচ্ছে এমন পূর্বাভাস পেয়েও তা উড়িয়ে
দিয়েছিলেন তিনি। শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার ষড়যন্ত্র সম্পর্কে
আগেই তথ্য ছিল ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ
অ্যান্ড ইন্টেলিজেন্স উইং, সংক্ষেপে ‘র’ এবং মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা
‘সিআইএ’সহ একাধিক বিদেশি সংস্থার কাছে। সম্ভাব্য এই অভ্যুত্থানের বিষয়ে ‘র’
এর কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধুকে সতর্কও করেছিলেন ভারতের
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী।
একইভাবে
ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ ১৯৭৪-এর ডিসেম্বর এবং ১৯৭৫-এর মার্চে সামরিক
অভ্যুত্থানের বিষয়ে সতর্ক করে। এ খবর উঠে এসেছে ইন্দিরা গান্ধীর একটি
আত্মজীবনীতে। মার্কিন দলিলপত্র অনুযায়ী, ’৭৪-এর মাঝামাঝি থেকে
ধারাবাহিকভাবেই সম্ভাব্য ক্যু এবং তার পরবর্তী সম্ভাব্য পরিস্থিতি নিয়ে
আলোচনা ছিল। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ নিয়মিতই এ বিষয়ে তথ্য পেলেও
পঁচাত্তরে সংস্থাটি ছিল পুরোপুরি নীরব। অবশ্য কোনো সতর্কতাকেই তেমন একটা
গুরুত্ব দেননি বঙ্গবন্ধু।
বাংলাদেশের
কেউ তাকে হত্যা করতে পারে এমন কথা তিনি বিশ্বাসই করতেন না। ‘ইন্দিরা
গান্ধী : এ বায়োগ্রাফি’ শীর্ষক বইয়ে ভারতীয় লেখক পুপুল জয়কর লিখেছেন,
‘বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারকে ১৫ আগস্টের
প্রভাতে বিদ্রোহী সেনাদল কর্তৃক হত্যার সংবাদ দেয়। মুজিব, তার স্ত্রী, তিন
পুত্র, দুই পুত্রবধূ এবং দুই ভাগ্নে নিহত হন। আমি আন্দাজ করতে পারি, এ
সংবাদ ইন্দিরার ওপর কী প্রতিক্রিয়া করবে।
র’-এর
তৎকালীন প্রধান রামেশ্বর নাথ কাও ১৯৭৪ সাল থেকে মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে
ষড়যন্ত্র সম্পর্কে তথ্য পেয়েছিলেন। তার (আর এন কাও) কাছে গোপন রিপোর্ট
পৌঁছে যে, বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর মধ্যে বিদ্রোহ পাকিয়ে তোলা হচ্ছে।
তিনি ব্যক্তিগতভাবে এটা সম্পর্কে ইন্দিরা গান্ধীকে সংক্ষিপ্ত বর্ণনাও দেন।
পরে ইন্দিরা গান্ধী ষড়যন্ত্র সম্পর্কে মুজিবকে অবহিত করার জন্য তাকেই
ঢাকায় পাঠান। ৩২ নম্বরের বাড়িতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা হয় তার।
আর এন
কাও-এর ভাষায়,—‘আমরা তখন বাগানের মধ্যে পায়চারি করছিলাম। আমি মুজিবকে বলি
যে, তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র সম্পর্কে আমাদের কাছে তথ্য আছে; কিন্তু তিনি
(বঙ্গবন্ধু) আনন্দিত ছিলেন।’ তিনি বলেন, ‘আমার কিছুই হতে পারে না, তারা
আমার লোক।’ এমনকি যদিও আমি সুনির্দিষ্ট তথ্যের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ তাকে
দিয়েছি, আমরা যতটুকু জানতে পেরেছি।’
১৯৭৫
সালের মার্চ মাসে কাওয়ের কাছে আরও বিস্তারিত খবর পৌঁছে যায়। সেটা হলো,
বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর মধ্যে মুজিবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র সংগঠিত হচ্ছে।
ইন্দিরা দ্রুতবেগে মুজিবকে অবহিত করেন। কিন্তু তিনি বিশ্বাস করতে অসম্মত
হন। তিনি তো বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা, তিনি তার আপন লোকজনের
দ্বারা গুপ্তহত্যার শিকারে পরিণত হতে পারেন না। ‘র’-এর কাছে থাকা
প্রতিবেদনগুলো ১৯৭৪ সালেও হালনাগাদ ছিল যে, বাইরের দেশের শক্তির মাধ্যমেই
ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন হয়।
বঙ্গবন্ধু
হত্যার খবর পাওয়ার পর ইন্দিরা গান্ধীর প্রতিক্রিয়া নিয়ে লেখক পুপুল জয়কর
লিখেছেন, ‘আমি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সন্ধ্যার দিকে তার (ইন্দিরা গান্ধী)
বাসভবনে যাই। আমি দেখতে পাই, তিনি নিজেও নিরাপত্তাহীনতার বিষয়ে মহাআতঙ্কিত।
তিনি (ইন্দিরা) আমাকে বলেন যে, মুজিব হত্যা হচ্ছে ষড়যন্ত্রের প্রথম ঘটনা।
এটাই উপমহাদেশকে ডুবিয়ে দেবে। মুজিব ইতিমধ্যেই প্রস্থান করলেন। ইন্দিরা
বিভিন্ন প্রমাণ ও যুক্তি দেখিয়ে বলেন, পরবর্তী লক্ষ্যবস্তু হবেন তিনি
নিজেই। মুজিবের শিশু ছেলেকে হত্যার খবর সব ধরনের শুভ চিন্তাকে ধ্বংস করে
দেয়। ভয় ভীতিগুলো প্রকট আকার ধারণ করে।
ইন্দিরা
বলেন, ‘আমি গোয়েন্দা প্রতিবেদনগুলো অগ্রাহ্য করেছি, কিন্তু তেমনটি আমি আর
করতে পারি না।’ রাজীবের পুত্র রাহুল মুজিবের পুত্রের সম-বয়স্ক। আগামীকাল
তারও এমনটি হতে পারে। তারা আমাকে ও আমার পরিবারকে ধ্বংস করতে চায়।’
আত্মজীবনীর লেখক পুপুল জয়কর আরও লিখেছেন, ‘১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে
ইন্দিরার সঙ্গে মতবিনিময় করা কঠিন হয়ে পড়ে। তিনি আমার সঙ্গে যখন দেখা করেন
তখনো তার দুই চোখ সবসময় সতর্ক থাকত।’
নিজের
মানুষের প্রতি বঙ্গবন্ধুর বিশ্বাস এতই দৃঢ় ছিল যে তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র
হচ্ছে এমন পূর্বাভাস পেয়েও তা উড়িয়ে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। ‘র’ এর পক্ষ থেকে
বঙ্গবন্ধুকে আগেই সতর্ক করা হয়েছিল। ভারতীয় সাংবাদিক সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত
তার মুজিব হত্যার ষড়যন্ত্র বইয়ে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার আগাম পূর্বাভাসের
বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।
`মুজিব
হত্যার ষড়যন্ত্র` বইটির ৮০ নম্বর পাতায় সুখরঞ্জন দাশ লিখেছেন, ‘মুজিব খুন
হয়ে যাওয়ার পর একটা প্রশ্ন প্রায়ই ওঠে, একটা চক্রান্ত যে চলছে এ-কথা জানা
সত্ত্বেও ভারত সরকার মুজিবকে বাঁচানোর জন্য কিছু করলো না কেন? সাতাত্তরের
ত্রিশ নভেম্বর ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে
তাঁর বাসভবনে এক সাক্ষাৎকার-কালে আমিও এই প্রশ্নটাই তুলি তাঁর কাছে।
শ্রীমতি গান্ধী আমাকে বলেন, কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে আমরাও তা জানতাম।
মুজিবকে আমি এ-সম্পর্কে বহুবার সতর্ক করে দেই। কিন্তু তিনি বরাবর আমাকে
বুঝিয়েছেন, পাকিস্তানের জেল থেকেই যখন বেরিয়ে আসতে পেরেছি, নিজের দেশের
জল্লাদকে নিশ্চয়ই এড়াতে পারব।’
বঙ্গবন্ধুকে
সতর্ক করা প্রসঙ্গে সাবেক ‘র’- প্রধান রামেশ্বর নাথ কাও সানডের পত্রিকায়
লিখেছেন, শেখ মুজিবুর রহমানের প্রাণনাশে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কতিপয়
উচ্ছৃঙ্খল সদস্যের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে আমরা আগাম তথ্য পেয়েছিলাম। আমি বিষয়টি
নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে কথা বলি। তাঁকে
আমরা বলি যে,এ সংক্রান্ত তথ্য অত্যন্ত সূক্ষ্ম সূত্র থেকে আমরা জানতে
পেরেছি। এসব সূত্রের পরিচয় যেকোনো মূল্যে গোপন রাখতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর
অনুমোদনক্রমে ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরে আমি ঢাকা সফর করেছিলাম। শেখ মুজিবুর
রহমানের সঙ্গে আমার শেষ বৈঠকের এক পর্যায়ে আমি তাঁকে বঙ্গভবনের [সম্ভবত
গণভবন] বাগানে একান্তে কিছু সময় দেওয়ার জন্য অনুরোধ করি। সেখানে আমি তাঁর
প্রাণনাশের আশঙ্কা নিয়ে আমাদের জানা তথ্য তাঁকে অবহিত করি। কিন্তু তিনি
উচ্ছ্বাসের সঙ্গে বাহু দুলিয়ে বলেন,‘তারা আমার নিজের সন্তান, তারা আমার
ক্ষতি করবে না’। আমি তাঁর সঙ্গে তর্কে যাইনি। শুধু এটুকু বলেছিলাম, এসব
তথ্য নির্ভরযোগ্য এবং ষড়যন্ত্র সম্পর্কে আমরা যা জানতে পেরেছি তা আমরা
তাঁকে অবহিত করব। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৭৫ সালের মার্চে আমি আমাদের একজন
জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে ঢাকায় পাঠিয়েছিলাম। তিনি শেখ মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ
করেছিলেন। এবং তাঁকে অবহিত করেছিলেন যে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পদাতিক ও
অশ্বারোহী ইউনিট তাঁর প্রাণনাশের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।
দুর্ভাগ্যবশত শেখ মুজিব এসব সতর্কতা অগ্রাহ্য করেছিলেন।
মার্কিন
দলিলেও অভ্যুত্থানের আগাম তথ্য : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা বা
বাংলাদেশে কোনো সেনা অভ্যুত্থান বিষয়ে ১৯৭৪ সালের শুরুর দিক থেকেই নানা
ধরনের বার্তা চালাচালি করেছে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর এবং ঢাকা, দিল্লি ও
ইসলামাবাদের মার্কিন দূতাবাস।
সম্প্রতি
উন্মোচন করে দেওয়া মার্কিন সিক্রেট বার্তাগুলোর বিশ্লেষণে দেখা যায়,
মুজিবের সেনা মোতায়েন শিরোনামে ১৯৭৪ সালের ৩ এপ্রিল ঢাকার মার্কিন দূতাবাস
থেকে ওয়াশিংটনে পাঠানো বার্তার বিষয়বস্তু ছিল বাংলাদেশের বেসামরিক যোগাযোগ,
দুর্নীতি, ভিন্নমতাবলম্বী উপদল, সেনা মোতায়েন। ’৭৪-এর ২ আগস্ট ঢাকা থেকে
পাঠানো আরেক সিক্রেট বার্তার শিরোনাম ছিল ‘সম্ভাব্য সরকার পরিবর্তনের বিষয়ে
আরও বিস্তারিত’।
’৭৪-এর ২৯
আগস্ট ওয়াশিংটন থেকে ঢাকার পরিস্থিতি জানতে চেয়ে পাঠানো তার বার্তার
শিরোনাম ছিল, ‘রাজনৈতিক পরিস্থিতি মূল্যায়নের অনুরোধ’। আবার ’৭৪-এর ৪
সেপ্টেম্বর ঢাকা থেকে ওয়াশিংটনে পাঠানো আরেকটি গোপন বার্তার শিরোনাম
‘অস্থিরতার সম্ভাবনা এবং বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিবর্তন।’ ‘মিসেস গান্ধী এবং
সিআইএ’ শিরোনামে আরেকটি বার্তা পাঠানো হয় ১৯৭৫ সালের ২৯ জুলাইয়ে। এমন আরও
বেশ কিছু তারবার্তা ইতিমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে। এগুলো নিয়ে ঢাকার এক
স্বনামখ্যাত সাংবাদিকের বইও প্রকাশ হয়েছে।
অন্যদিকে,
ইউএস ওরাল হিস্টোরি প্রোগ্রামের আওতায় চার্লস স্টুয়ার্ট কেনেডি নামের এক
ইতিহাসবিদকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ১৯৭৫ সালে ওয়াশিংটনে স্টেট ডিপার্টমেন্টে
বাংলাদেশ ডেস্কের কর্মকর্তা স্টিফেন আইজেন ব্রাউন দাবি করেন, সম্ভাব্য
সামরিক অভ্যুত্থান সম্পর্কে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর তথ্যের
ভিত্তিতে ঢাকার দূতাবাস অবগত ছিল। এ কারণে তারা অভ্যুত্থানের খবর ও
অভ্যুত্থানের অংশগ্রহণকারীদের বিষয়ে জেনে খুব একটা বিস্ময়বোধ করেননি।
যদিও এই
সাক্ষাৎকারে ওয়াশিংটনে থাকা এই কর্মকর্তা দাবি করেন, ঢাকার মার্কিন দূতাবাস
থেকে বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক করা হয়েছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে মার্কিন দূতাবাস
সতর্ক করেছে এমন কোনো তথ্য বঙ্গবন্ধুর তৎকালীন কোনো সহকর্মী শোনেননি। বরং
সিআইএ এবং ঢাকার মার্কিন দূতাবাস এই ষড়যন্ত্রের বিষয়ে অনেক বেশি তথ্য থাকা
সত্ত্বেও নীরবতা পালন করেছে। সিআইএর এই সম্পৃক্ততা ও নীরবতার তথ্য এসেছে
পঁচাত্তরের ঘটনাবলি নিয়ে বাংলাদেশিদের একাধিক বইতে।
No comments:
Post a Comment